বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায়, বিশেষ করে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে, ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীরা বর্তমানে একটি ন্যায্য দাবি নিয়ে তীব্র আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। তারা রাস্তায় নেমে প্রশ্ন তুলেছে যে, কীভাবে এসএসসি (ভোকেশনাল), এইচএসসি (ভোকেশনাল) এবং পদার্থ, রসায়ন, গণিতে স্নাতক ডিগ্রিধারী ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টররা জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে পদোন্নতি পেতে পারেন, যখন এই পদের মূল দায়িত্ব হলো ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগত বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া। পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ২০২৫ এর মূল কারণ হলো শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় যোগ্যতা ও দক্ষতার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠার দাবি, যা কেবল একটি প্রতিবাদ নয়, বরং একটি সুষ্ঠু ও মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থার জন্য তাদের একযোগে সোচ্চার হওয়ার প্রয়াস।

আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টর পদে নিয়োগের জন্য সাধারণত এসএসসি (ভোকেশনাল), এইচএসসি (ভোকেশনাল) এবং পদার্থ, রসায়ন, গণিতে স্নাতক ডিগ্রি যোগ্যতা হিসেবে নির্ধারিত থাকলেও, এই শিক্ষাগত পটভূমি তাদের শুধু প্রাথমিক পর্যায়ের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য উপযুক্ত করে, যেখানে জুনিয়র ইন্সট্রাক্টরদের দায়িত্ব হলো ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীদের সিভিল, মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স, কম্পিউটার সায়েন্স এর মতো টেকনোলজি-ভিত্তিক বিষয় শেখানো—যা দুই পদের মধ্যে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও দায়িত্বের স্পষ্ট বৈষম্য তুলে ধরে। তবুও, ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টরদের জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ জন্ম দিয়েছে, যার ফলে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ২০২৫ সালের মার্চে শিক্ষার্থীরা তাদের দীর্ঘদিনের হতাশা ও শিক্ষার গুণগত মান, চাকরির সুযোগ এবং পেশাগত মর্যাদা নিয়ে সরকারের উদাসীনতার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ, পরীক্ষা বর্জন ও অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে কারিগরি শিক্ষায় বড় ধরনের সংস্কারের দাবি জানিয়েছে, যা দেশব্যাপী শিক্ষা কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটিয়ে জাতীয় আলোচনা ও কারিগরি শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।

ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টর
ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টররা কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক পর্যায়ের সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সাধারণত এসএসসি (ভোকেশনাল), এইচএসসি (ভোকেশনাল) এবং কিছু ক্ষেত্রে পদার্থ, রসায়ন, গণিতে স্নাতক ডিগ্রি।
কাজের পরিধি:
ল্যাব এসিস্ট করা: তারা শিক্ষক বা উচ্চপদস্থ প্রশিক্ষকদের নির্দেশনায় ল্যাবে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করেন।
যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচ্ছন্নতা: ল্যাবের সরঞ্জামাদি পরিষ্কার, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রস্তুত রাখা তাদের প্রধান দায়িত্ব।
পরীক্ষামূলক কাজে সহযোগিতা: শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণে সহায়ক হিসেবে কাজ করেন, তবে শিক্ষাদানের প্রধান দায়িত্ব তাদের নয়।
ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টরদের কাজ প্রযুক্তিগত শিক্ষার মূল স্রোতের চেয়ে সহায়ক ভূমিকায় সীমাবদ্ধ। তাদের দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের শেখানোর পরিবর্তে ল্যাব পরিচালনা ও সহযোগিতার মধ্যে আবর্তিত হয়। এই পদে প্রয়োজনীয় দক্ষতা যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রাথমিক প্রশিক্ষণে সীমিত, যা ডিপ্লোমা স্তরের জটিল প্রযুক্তিগত শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই তাদের শিক্ষাগত পটভূমি এবং কাজের প্রকৃতি উচ্চতর শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত নয়।

জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর
জুনিয়র ইন্সট্রাক্টররা ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীদের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এই পদে নিয়োগের জন্য সাধারণত ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং বা তার চেয়ে উচ্চতর ডিগ্রি প্রয়োজন হয়, যা প্রযুক্তিগত বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও দক্ষতা নিশ্চিত করে।
কাজের পরিধি:
প্রযুক্তিগত শিক্ষাদান: তারা শিক্ষার্থীদের মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা দেন।
কোর্স পরিচালনা: ডিপ্লোমা কারিকুলামের জটিল বিষয়গুলো বোঝানো এবং শিক্ষার্থীদের প্রকল্প ও পরীক্ষায় গাইড করা।
দক্ষতা উন্নয়ন:: শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে তোলা তাদের মূল লক্ষ্য।
জুনিয়র ইন্সট্রাক্টরদের কাজ সরাসরি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান ও ভবিষ্যৎ দক্ষতার সঙ্গে জড়িত। এই পদে থাকতে হলে শিক্ষককে নিজেকে ডিপ্লোমা স্তরের প্রযুক্তিগত জ্ঞানে পারদর্শী হতে হবে। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা এই পদের জন্য আদর্শ কারণ তারা চার বছরের কঠোর কোর্সে এই জ্ঞান অর্জন করে। ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টরদের তুলনায় তাদের দায়িত্ব ও যোগ্যতার স্তর অনেক উচ্চ।
একজন ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টর ল্যাবে যন্ত্রপাতি পরিচালনায় দক্ষ হতে পারেন, কিন্তু তিনি কি ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট ডিজাইন বা মেকানিক্যাল ড্রয়িংয়ের তত্ত্ব শেখাতে পারবেন? এই প্রশ্নের উত্তরই সমস্যার মূল চিহ্নিত করে।


আন্দোলনের পক্ষে যৌক্তিক বিশ্লেষণ
১। যোগ্যতার মানদণ্ডে বিশাল ফারাক:
ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টরদের শিক্ষাগত যোগ্যতা – এসএসসি ও এইচএসসি (ভোকেশনাল) এবং পদার্থ, রসায়ন, গণিতে স্নাতক – তাদের প্রযুক্তি-ভিত্তিক বিষয়ে গভীর জ্ঞান বা ব্যবহারিক দক্ষতা প্রদানের জন্য যথেষ্ট নয়। ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে যে স্তরের প্রযুক্তিগত শিক্ষা দেওয়া হয়, তা শেখাতে হলে শিক্ষকদের নিজেরই ডিপ্লোমা বা তার চেয়ে উচ্চতর ডিগ্রি থাকা জরুরি। এই ক্ষেত্রে, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররাই এই পদের জন্য সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী।
২। শিক্ষার মানের ওপর সরাসরি প্রভাব:
জুনিয়র ইন্সট্রাক্টরদের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা উন্নত প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ আশা করে। কিন্তু যদি ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টররা, যাদের প্রযুক্তি-ভিত্তিক বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা নেই, এই পদে আসেন, তাহলে শিক্ষার্থীরা অপ্রতুল শিক্ষা পাবে। এটি তাদের ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার ঘাটতি তৈরি করবে।
৩। নন-টেকনোলজি বনাম টেকনোলজি:
ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টরদের শিক্ষাগত পটভূমি নন-টেকনোলজি ভিত্তিক। পদার্থ, রসায়ন, গণিতে স্নাতক ডিগ্রি থাকলেও, এটি ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। অন্যদিকে, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা চার বছরের কঠোর প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত কোর্সের মাধ্যমে এই পদের জন্য প্রস্তুত হয়। তাই, এই পদে ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টরদের পদোন্নতি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
৪। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের অসঙ্গতি:
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এই পদোন্নতি প্রক্রিয়ায় যোগ্যতার কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের বাদ দিয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টরদের পদোন্নতি দেওয়া প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বচ্ছতার অভাবের প্রমাণ। এটি শিক্ষা ব্যবস্থায় অবিচারের একটি উদাহরণ।
৫। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে:
অযোগ্য শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করলে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। বাংলাদেশের শিল্প খাত, যা দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের ওপর নির্ভরশীল, এই সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

কেন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররাই যোগ্য?
প্রযুক্তিগত জ্ঞান:
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা চার বছরের কোর্সে ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজি, ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ও প্রকল্প-ভিত্তিক কাজে দক্ষতা অর্জন করে।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সামঞ্জস্য:
তারা নিজেরাই ডিপ্লোমা কোর্সের অংশ ছিলেন, তাই শিক্ষার্থীদের চাহিদা ও দুর্বলতা ভালো বোঝেন।
ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টরদের এই ধরনের প্রযুক্তিগত জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা না থাকায় তারা এই পদের জন্য সম্পূর্ণ অযোগ্য।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ৬ দফা দাবি
উল্লিখিত ৬টি দাবি বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার, ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীদের পেশাগত মর্যাদা ও সুযোগ বৃদ্ধি এবং শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের লক্ষ্যে উত্থাপিত হয়েছে।
১. জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে অবিলম্বে ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের ৩০% প্রমোশন কোটা বাতিল করতে হবে।
এই দাবির মূল উদ্দেশ্য হলো জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের জন্য নির্ধারিত ৩০% পদোন্নতি কোটা বাতিল করা। ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের শিক্ষাগত যোগ্যতা (যেমন: এসএসসি/এইচএসসি ভোকেশনাল এবং পদার্থ, রসায়ন, গণিতে স্নাতক) তাদের প্রাথমিক পর্যায়ের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য উপযুক্ত হলেও, জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের টেকনোলজি-ভিত্তিক বিষয় (যেমন: মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট) পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় গভীর প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা তাদের নাও থাকতে পারে। এই কোটা ব্যবস্থা শিক্ষার গুণগত মানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই এই দাবি যৌক্তিক, কারণ এটি শিক্ষকদের যোগ্যতা ও দক্ষতার মানদণ্ড নিশ্চিত করার উপর জোর দেয়।
২. জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর (টেক) পদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বাধ্যতামূলক “ডিপ্লোমা প্রকৌশল” ডিগ্রি থাকতে হবে।
এই দাবি জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে নিয়োগের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নির্ধারণের উপর জোর দেয়। এটি যৌক্তিক, কারণ ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তিগত বিষয়ে পড়ানোর জন্য শিক্ষকের নিজেরই সেই বিষয়ে গভীর জ্ঞান ও ব্যবহারিক দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। ডিপ্লোমা প্রকৌশল ডিগ্রিধারী শিক্ষকরা এই বিষয়ে বিশেষায়িত হওয়ায় তারা শিক্ষার্থীদের আরও কার্যকরভাবে শিক্ষা দিতে পারবেন। এই দাবি শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি এবং শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
৩. ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর সহ দেশের কারিগরি সকল পদে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবল নিয়োগ দিতে হবে।
এই দাবি কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার সকল পদে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদের নিয়োগের উপর জোর দেয়। এটি যৌক্তিক, কারণ কারিগরি শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত পদগুলোতে যারা নিজেরা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন, তারাই সেই বিষয়ে সঠিকভাবে শিক্ষা প্রদান করতে পারবেন। উদাহরণস্বরূপ, ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর পদে যদি কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি নিয়োগ করা হয়, তবে তারা প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক দক্ষতা শেখাতে আরও কার্যকর হবেন। এই দাবি কারিগরি শিক্ষার সামগ্রিক মান উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৪. কারিগরি (পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট শিক্ষার্থীদের জন্য) সকল বিভাগীয় শহর গুলোতে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।
এই দাবি পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির জন্য বিভাগীয় শহরগুলোতে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব করে। এটি যৌক্তিক, কারণ বাংলাদেশে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত। অনেক শিক্ষার্থী ডিপ্লোমা শেষ করার পর বি.এসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়, কিন্তু ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য একটিমাত্র পাবলিক প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট- ঢাকা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি) হওয়ায় তাদের সুযোগ উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। বিভাগীয় শহরগুলোতে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলে শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার সুযাগ বৃদ্ধি পাবে, সহজে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে, যা তাদের ক্যারিয়ার উন্নয়নে সহায়ক হবে।
৫. কারিগরি শিক্ষা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের চাকরির আবেদনের সুযোগ বাস্তবায়ন করতে হবে।
এই দাবি ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে চাকরির আবেদনের সুযোগ সৃষ্টির উপর জোর দেয়। এটি যৌক্তিক, কারণ ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও ব্যবহারিক দক্ষতা সম্পন্ন হওয়ায় তারা প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে পারেন। এছাড়া, ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ্যক্রমে সাধারণ বিষয়ে (যেমন: বাংলা, ইংরেজি, গণিত) জ্ঞান লাভ করে থাকায়, তারা প্রাথমিক শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সাধারণ বিষয়গুলো শেখানোর ক্ষেত্রে সক্ষম হতে পারেন।
৬. ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য প্রাইভেট সেক্টরে সর্বনিম্ন বেতন স্কেল নির্ধারণ করে দিতে হবে।
এই দাবি ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের জন্য প্রাইভেট সেক্টরে সর্বনিম্ন বেতন স্কেল নির্ধারণের প্রস্তাব করে। এটি অত্যন্ত যৌক্তিক, কারণ বাংলাদেশে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা প্রায়ই প্রাইভেট সেক্টরে নিম্ন বেতনে কাজ করতে বাধ্য হন, যা তাদের শিক্ষা ও দক্ষতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একটি সর্বনিম্ন বেতন স্কেল নির্ধারণ করা হলে তাদের পেশাগত মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। এটি তরুণদের কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তুলতেও সহায়ক হবে। এই দাবি বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে প্রাইভেট সেক্টরের সাথে সমন্বয় করে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
এই ৬টি দাবি সামগ্রিকভাবে কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার, শিক্ষকদের যোগ্যতা নিশ্চিতকরণ, শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি এবং ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের পেশাগত মর্যাদা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উত্থাপিত করা হয়েছে। বেশিরভাগ দাবি যৌক্তিক এবং শিক্ষার্থীদের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সহায়তা করবে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু পদক্ষেপ এই দাবিগুলোর বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

আন্দোলনের তাৎপর্য
পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ২০২৫ এর মাধ্যমে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীরা তাদের নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবি তুলে ধরেছে। ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাফল্যের পর তরুণরা বুঝেছে যে, ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠ অবিচারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অস্ত্র। এই আন্দোলন প্রশাসনকে বাধ্য করছে যোগ্যতার মানদণ্ড পুনর্বিবেচনা করতে।
পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ২০২৫ শিক্ষা ব্যবস্থায় যোগ্যতা ও ন্যায্যতার প্রশ্ন তুলেছে। ক্রাফ্ট ইন্সট্রাক্টরদের অযৌক্তিক পদোন্নতি বন্ধ করে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের এই পদে সুযোগ দেওয়াই যৌক্তিক। এটি শুধু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে না, বরং বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষাকে বিশ্বমানে উন্নীত করবে। প্রশাসনের উচিত এই আন্দোলনকে গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের পথ খুঁজে বের করা।
বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আন্দোলনের প্রভাব
এই আন্দোলন বাংলাদেশের বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ফেলেছে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব তুলে ধরা হলো:
১. ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট (DPI):
দেশের বৃহত্তম ও প্রাচীনতম পলিটেকনিক হিসেবে DPI এই আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। এখানকার শিক্ষার্থীরা পর্বমধ্য পরীক্ষা ও নিয়মিত ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। শিক্ষকদের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে—কেউ শিক্ষার্থীদের সমর্থন করলেও কেউ এই ব্যাঘাতের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।


২. চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট:
শিল্পাঞ্চলের কাছাকাছি হওয়ায় এখানকার শিক্ষার্থীরা চাকরির সুযোগ নিয়ে বেশি সোচ্চার। আন্দোলনের কারণে এখানে শিল্প প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চলমান প্রশিক্ষণ কর্মসূচি স্থগিত হয়েছে।

৩. রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট:
এখানে আন্দোলন তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ হলেও পরীক্ষা বর্জনের কারণে শিক্ষাবর্ষের সময়সূচি পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রশাসন চাপের মুখে রয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করছে।
৪. সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট:
এই প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনের প্রভাবে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা গেছে। অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষকদের নীরবতায় ক্ষুব্ধ, যা প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক পরিবেশকে প্রভাবিত করছে।

৫. ময়নমসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট:
শিক্ষার্থীরা পর্বমধ্য পরীক্ষা ও নিয়মিত ক্লাস বর্জন করে আন্দোলনে অবস্থান কর্মসূচী পালন করছে। দাবী আদায়ের লক্ষ্যে ময়মনসিংহ ডিসি অফিস ঘেরাও কর্মসূচী পালন করেছে।


৬. বেসরকারি পলিটেকনিকগুলো:
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কম হলেও আন্দোলনের প্রভাবে সরকারি নীতি পরিবর্তনের আশঙ্কায় প্রশাসন উদ্বিগ্ন। অনেক প্রতিষ্ঠানে ক্লাস চালু রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে গেছে।
আন্দোলনরত বিভিন্ন ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীদের স্থির চিত্র















ধন্যবাদ এতো সুন্দর করে সুস্পষ্ট ধারণা দেওয়ার জন্য।